অক্টোবর ১৭৯৩, প্যারিস। জনতার আদালত (Tribunal Révolutionnaire) বসেছে প্লাস দ্য লা রেভলুশনে। চারদিকে বিপ্লবী জনতার ভীড়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রক্তের গন্ধ এবং বিপ্লবের অমোঘ নিয়তি।
১২ জন জুরি, ৫ জন বিচারক লাল স্কার্ফ পরে বসে আছেন, প্রতীকীভাবে রক্তস্রোতকে স্মরণ করিয়ে দিতে। জুরি ও বিচারকরা সবাই বিপ্লব-উত্তর গণপরিষদ কর্তৃক বাছাইকৃত।
প্রধান বিচারক মার্শাল হেরমান (Martial Herman), বিপ্লবী জ্যাকোবিন ক্লাব (Jacobin Club)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনে কাঠগড়ায় একজন জিরোনডিন্স (Girondins) নেতা। জনতা উন্মত্ত, মুখে স্লোগান—"গণতন্ত্রের শত্রুকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে!" কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তি শান্ত, তার চোখে কোনো ভয় নেই।
বিচারক হেরমান—স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের অগ্নিবীর—কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি বিপ্লবী সরকারের অধীনে গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করো?”
অভিযুক্ত ব্যক্তি মৃদু হেসে বলল, “স্বাধীনতা কি আনুগত্য দাবি করতে পারে?”
ভীড়ের মধ্যে চাপা গুঞ্জন উঠল। জুরি-বিচারকেরা কেউ কেউ হতবাক, কেউ বা বিরক্ত। সমবেত বিক্ষুব্ধ জনতা একে "বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র" হিসেবে দেখছে। গণতন্ত্রপ্রিয় জনতা চিৎকার করে উঠল, "ও গণতন্ত্র মানেই না! বিশ্বাসঘাতক! গণতন্ত্রের শত্রু!"
বিচারক গম্ভীরভাবে বললেন, "যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তারা গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। তোমার বক্তব্য উপস্থাপনের অধিকার নেই।"
লোকটি এবার মাথা তুলে বলল, "আমি গণতন্ত্রের অধীনে বিচার চাইনি, বরং তোমরা আমাকে গণতন্ত্রের নামে বিচার করছো। বিপ্লবের আগে ভলতেয়ার বলতেন, তোমাদের কথা আমার অপছন্দ হলেও, তা বলার অধিকার রক্ষায় আমি প্রাণ দিতেও রাজি। আর আজ তোমরা ভিন্নমতের জন্য জীবন কেড়ে নিচ্ছো! রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের পরিবর্তে কি আমরা গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারই পেলাম, মঁসিয়ো?"
বিচারক কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “তুমি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, অথচ গণতন্ত্রের আইনে নিজেকে রক্ষা করতে এসেছ? এই স্ববিরোধিতা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?”
ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে বলল, "অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের অধিকার কেউই কেড়ে নিতে পারে না, এমনকি আমি যদি তোমাদের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নাও হই। কারণ ওটা আমার অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্য অধিকার। তুমি গণতন্ত্রের নামে, রাজতন্ত্রের নামে কিংবা কমিউনিজমের নামে, যে নামেই আমার এই অধিকার কেড়ে নাও না কেন, তোমার পরিচয় একটাই: তুমি নিপীড়ক, তুমি জালিম।"
বিচারক বিরক্ত হয়ে বললেন, "জনগণ, কী রায় তোমাদের?"
স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনতা গর্জে উঠল, "মৃত্যুদণ্ড! গণতন্ত্রের শত্রুর জন্য এটাই প্রাপ্য!"
লোকটি হাসল, যেন অনেক আগে থেকেই এই বাক্যের জন্য প্রস্তুত ছিল, “অপূর্ব পরমতসহিষ্ণু ও চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তোমাদের গণতন্ত্র! অপূর্ব বৈচিত্র্য তোমাদের বহুত্ববাদে! আমি এখন স্বাধীনভাবে তোমাদের অধীন।”
এমন চরম উত্তেজনার মুহূর্তে হঠাৎ জনতার মধ্য থেকে কে একজন উচ্চস্বরে বলে উঠল, "এই রায় বিপ্লবের চেতনার বিরুদ্ধে! আমরা কি রাজতন্ত্রের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছি?"
হতভম্ব জনতা ওই জনৈক ব্যক্তির আকস্মিক নির্বুদ্ধিতায় ক্ষুব্ধ হল এবং "চুপ গণতন্ত্রের শত্রু, চুপ" বলে গর্জে উঠলো।
তারপর যখন সব স্বাভাবিক হলো, প্রধান বিচারক এবার উচ্চারণ করলেন চূড়ান্ত রায়, “জনগণের শত্রু হিসেবে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা যাবে না।”
তারপর জনতার উল্লাসের মধ্যে রায় কার্যকর হলো। গণতান্ত্রিক গিলোটিনের ফলক নেমে এলো, প্লেস দ্য লা রেভলুশনে রক্তমাখা পাথরে আরেকটি মাথা গড়িয়ে পড়ে। উল্লসিত জনতা স্লোগান দিল: "গণতন্ত্র জিন্দাবাদ।" "বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।"
এভাবে গণতন্ত্র তার শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে বিজয়ী হলো। ন্যায়বিচার আবারও গণতান্ত্রিক গিলোটিনের ছুরিতে প্রতিষ্ঠিত হলো। গণতন্ত্র তার ছুরির ধার প্রমাণ করলো।